আমাদের ভাষা আন্দোলন জাদুঘর

ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা
অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে বছরে একবার অন্তত বাংলা একাডেমি চত্বরে বাড়ে মানুষের পদচারণা। অথচ খুব কম দর্শনার্থীই জানেন, বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের দোতলায় 'ভাষা আন্দোলন জাদুঘর' রয়েছে। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাষা আন্দোলন জাদুঘর পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। সেদিক থেকে এই জাদুঘরটি অনন্য। কিন্তু লেখক বা দর্শনার্থীরা যে ভাষা আন্দোলন জাদুঘরটি দেখবেন, তার সুযোগ খুবই কম। কারণ জাদুঘরের বাইরে চোখে পড়ার মতো কোনো সাইনবোর্ড নেই। বলতে গেলে, জাদুঘরটি সারা বছরই থাকে দর্শকশূন্য।
এই জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, স্মারকপত্র, ব্যঙ্গচিত্র, চিঠি, প্রচারপত্র, পাণ্ডুলিপি, পুস্তক-পুস্তিকার প্রচ্ছদ এবং ভাষাশহীদদের স্মারকবস্তু সংরক্ষরণ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে 'পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু' শীর্ষক পুস্তিকার প্রচ্ছদ, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র-জনতার বিভিন্ন মিছিলের আলোকচিত্র, অগ্রসরমান মিছিলকে বাধা প্রদানে সারিবদ্ধ পুলিশ বাহিনী, ধর্মঘট চলাকালে পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত ছাত্রনেতা শওকত আলীকে শেখ মুজিবুর রহমান রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ছবি, ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে বক্তৃতারত মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সম্পর্কে প্রেস বিজ্ঞপ্তি, পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি, ভাষাশহীদদের আলোকচিত্র ও পরিচিতি, ভাষাশহীদদের বিভিন্ন স্মারকবস্তু, প্রথম শহীদ মিনার ও প্রভাতফেরির আলোকচিত্র। মাত্র চার কক্ষবিশিষ্ট এই জাদুঘরের দেয়ালে দেয়ালে ঝোলানো এসব আলোকচিত্র, দর্শককে তৎকালীন ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে বাংলাভাষা নিয়ে বাঙালি মুসলিমদের দ্বন্দ্বের ইতিহাস। জাদুঘরের আলোকচিত্র ও দৈনিক আজাদের পেপার কাটিং দেখলেই মাতৃভাষা আন্দোলনের বাস্তবতা বোঝা যায়।
ভাষাশহীদ রফিকের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সার্টিফিকেট, ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের ব্যবহূত কোট, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের স্মারকলিপি, বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থের পৃষ্ঠা ও ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের প্রিয় চটের ব্যাগটিও এখানে সংরক্ষিত আছে। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। ভাষার মাসে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর খোলা থাকে।
ভাষা আন্দোলন জাদুঘর : ভাষা আন্দোলন জাদুঘর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাভাষার পরিচয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, এ আন্দোলনের যাবতীয় তথ্যাবলি এবং ভাষাশহীদ ও ভাষাসংগ্রামীদের যাবতীয় স্মৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর। ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অধ্যাপক এমএ বার্নিকের উদ্যোগে জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
জাদুঘরের প্রথম অফিস অস্থায়ীভাবে ড. নূরুল হক ভূঁইয়ার আসাদ গেটের বাসভবন ২/৯, ব্লক-এ, লালমাটিয়া স্থাপন করা হয়। পরে ১৬ ওয়েস্ট অ্যান্ড স্ট্রিট, ধানমণ্ডি অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসভবন ও ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেট হয়ে ২০০৬ সালে কাজী গোলাম মাহবুবের বাসভবনে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে জাদুঘর যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা, সিলেট থেকে প্রকাশিত নওবেলাল পত্রিকা এবং সমকালীন অন্যান্য পত্রপত্রিকা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসবিষয়ক তথ্যবহুল গ্রন্থ প্রকাশ; ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, সাময়িকী সংগ্রহ এবং একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্য গ্রন্থ সংগ্রহ; ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বর্ষপঞ্জিকে ভিত্তি করে মুহম্মদ তকীয়ুল্লাহ কর্তৃক প্রণীত 'প্রমিত বাংলা বর্ষপঞ্জি' ভাষা আন্দোলন জাদুঘর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রচারের পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে; ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর ছবি জ্ঞাত ছিল না, জাদুঘরের উদ্যোগে অহিউল্লাহর গঠনপ্রকৃতির বিবরণের ভিত্তিতে শিল্পী শ্যামল বিশ্বাসকে দিয়ে ওই শহীদের একটি ছবি অঙ্কন করা হয়েছে; ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জাদুঘরের 'প্রদর্শন বিভাগ' চালু করা হয়েছে; জীবিত ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সব ভাষাসংগ্রামী ও ভাষাশহীদের স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ কার্যক্রম চলছে। এ পর্যন্ত ভাষাসৈনিকের শতাধিক পূর্ণাঙ্গ জীবনী সংগৃহীত হয়েছে এবং ভাষাশহীদ পরিবার, ভাষাসংগ্রামী পরিবার, জীবিত ভাষাসংগ্রামী এবং আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্মৃতিচিহ্ন বা স্মারক সংগৃহীত হয়েছে।
ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা : বরকতের স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের পাশে অবস্থিত 'আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা'। একটি কক্ষ নিয়ে গড়ে উঠেছে এ জাদুঘর। এখানে রয়েছে ভাষাশহীদ আবুল বরকতের ব্যবহূত হাতঘড়ি, একটি খেলনা, তিনটি কাপ ও পিরিচ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সালের বিভিন্ন সময়ে বাবাকে লেখা বরকতের তিনটি চিঠি, বরকতের ডিগ্রি মার্কশিট ও সার্টিফিকেট এবং তাকে নিয়ে প্রকাশিত বাংলা একাডেমির বই এখানে সংরক্ষিত আছে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতি স্বরূপ আবুল বরকতকে ২০০০ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। সেটিও এখানে আছে। ১৯৫২ সালে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে মহান ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন আবুল বরকত। ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর রাতে তিনি শাহাদাতবরণ করেন।
স্মৃতিফলক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই দেয়ালে বিশাল ক্যানভাসে আঁকা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবিতে ছাত্রদের মিছিল। মিছিলে সরকারি বাহিনীর গুলিবর্ষণ। গুলিতে শহীদ ও তাদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার এবং তারপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শ্রদ্ধাঞ্জলি ও প্রভাতফেরি। ডান পাশে নিদর্শন ও আলোকচিত্র। নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে ভাষাশহীদ আবুল বরকতের ব্যবহূত একটি খেলনা, তিনটি কাপ-পিরিচ, বাবাকে লেখা বরকতের তিনটি চিঠি, বরকতের ডিগ্রির সনদ। ১৯৪৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর লেখা চিঠিতে বরকত তার বাবাকে বলছেন, 'এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি। দু-চার দিনের মধ্যে হয়ে যাব।' ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পাঠানোর তাগিদ দিয়ে তিনি লিখেছেন, 'আপনি যে টাকা দিয়েছেন উহাতে হইবে না। কারণ ভর্ত্তি হইতে প্রায় ৬০/৭০ টাকা লাগিবে। তার ওপর একখানি তক্ত... লণ্ঠন ও আরও দু'একটা জিনিসপত্রও কিনিতে হইবে। আপনি ৫০ টাকা ধার করিয়া পাঠাইয়া দিবেন...।'
এই সংগ্রহশালায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের আন্দোলন, ২১ ফেব্রুয়ারি বরকতের কবরে তার বাবা-মায়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রভাতফেরি, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাতফেরির ছবি, একুশের গানসহ নানা ঘটনার আলোকচিত্র রয়েছে। ঐতিহাসিক এসব ছবি যে কারও মনে শিহরণ জাগাবে। জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রতি রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকে।
আপনার মতামত লিখুন