সোমবার, ০৫ মে ২০২৫ | ২২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
গাঁও গেরাম

সমন্বিত খামারে গোপন বিপদ; সুবর্ণচরে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

আরিফুর রহমান, সুবর্ণচর (নোয়াখালী) প্রতিনিধি:
৫ ঘণ্টা আগে

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সমন্বিত মৎস্য খামার। মাছ চাষের পাশাপাশি একই স্থানে হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন করে বেশ ভালো লাভ করছেন খামারিরা। তবে অর্থনৈতিক সুবিধার আড়ালে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য এক অদৃশ্য হুমকি হয়ে উঠেছে এই খামার পদ্ধতি।

সুবর্ণচরে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী লেয়ার ও ব্রয়লার মিলে ৮ টি ইউনিয়নে ৭২টি ওয়ার্ডে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মোট খামারের সংখ্যা ৬১টি। কিন্তু প্রাণী সম্পদের পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। তথ্যানুযায়ী উপজেলায় ছোট বড় প্রায় ৫ শতাধিক সমন্বিত খামার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৫ ভাগ পোল্ট্রি খামার সমন্বিত পদ্ধতির বাহিয়ে আছে। 

উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের ২০২৩-২৪ সালের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী সমন্বিত পোল্ট্রি খামারে সংখ্যা ২০৭ টি। তবে এর সংখ্যা মাঠ পর্যায়ে তিনগুন হতে পারে। সমন্বিত পোল্ট্রির সংখ্যা যাই হোক এ পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও জীব-বৈচিত্র্য এবং জনস্বার্থের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান জানান, সমন্বিত খামারের ফলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ, পজনন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মাছের স্বাদ বিনষ্ট হচ্ছে। এধরণের সমন্বিত পোল্ট্রি খামারে সব প্রজাতির মাছ চাষ সম্ভব নয়। ফলে বেশি উৎপাদনশীল মাছ উৎপাদন করা প্রায় ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। সুবর্ণচরে  চলতি অর্থ বছরে মাছের উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ১৪৪৮৭ মে:টন যা গত অর্থ বছরের চেয়ে ৬৯০ মে:টন বেশি। উপজেলায় প্রায় ৪ লাখ মানুষের জনপ্রতি প্রতিদিন ০.৭০ গ্রাম করে ২৯ মে:টন মাছের চাহিদা মিটিয়ে বাকি গুলো দেশের জাতীয় চাহিদায় যুক্ত হচ্ছে।সুবর্ণচরে উৎপাদিত মাছ জিডিপিতে ০.২৮ শতাংশ অবদান রেখে চলছে। তবে সব প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সমন্বিত মাছ চাষ একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি, যেখান সব প্রজাতির মাছ উৎপাদন সম্ভব নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পুকুরের পানিতে সরাসরি পোল্ট্রি খামার, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির মলবর্জ্য মিশে গিয়ে পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। এসব পানিতে ছোট ছোট জীব ও জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পোল্ট্রি বর্জ্য পানির গুনগত মান ও জলজ প্রানীর খাদ্য শৃংখল বিনষ্ট হচ্ছে। পুকুরে বাড়ছে এমোনিয়া গ্যাসের পরিমান। বিশেষ করে পোল্ট্রিতে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক বর্জ্যের মাধ্যমে মাছের শরীরে মিশে পরোক্ষভাবে তা মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে। এতে ঝুঁকি বাড়ছে খাদ্য নিরাপত্তায় ও মানবদেহের।

এবিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, খাবারের সঙ্গে আমরা অজান্তেই বিষ খাচ্ছি। প্রোটিন, আমিষ ও ভিটামিন-এ এর জন্য মাছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। সমন্বনিত পোল্ট্রি  অথবা গবাদিপশুর খামারে যদি দ্রুত বৃদ্ধি কারক রাসায়নিক ফিড ব্যবহার করে অথবা এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে তাহলে এটা মাছের মাধ্যম হয়ে মানবদেহে আসতে পারে। ফলে মানব দেহে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি রোগ, গর্ববতী মায়ের নানা জটিলতা ও শিশু বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। 

পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য নিয়ে শংকার কথা জানালেন, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থপনা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. মুহিনুজ্জামান। তিনি বলেন, সমন্বয়িত পোল্ট্রি খামারে পানি সাভাবিক রাখার  ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে এ দুষিত মাটি ও আশপাশ। দুষিত পানির ফলে ছোট বড় প্রাণীর অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে এবং মারা যাচ্ছে। এছাড়াও দীর্ঘ মেয়াদে  মাছের সাভাবিক খাদ্য শৃংখল বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে মাছ উৎপাদনে একটা ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া দুষিত পানি কৃষি জমিতে মিশ্রিত হলে কৃষি পরিবেশও বিঘ্নিত হবে।

এ বিষয়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিসারিজ এন্ড মেরিন সায়ন্স বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সমন্বিত পোল্ট্রি খামারে মাছ চাষের বিষয় আমাদের গবেষণা চলমান রয়েছে। সমন্বিত পোল্ট্রি খামারে মাছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কেমন রয়েছে এবিষয়ে আমার ডিপার্টমেন্ট কাজ করছে। পোল্ট্রি খামারের পুকুর ও খামারে পোল্ট্রির পরিমান সমন্বয় করে চাষ করা উচিত। তবে পোল্ট্রি খামারে যদি এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, তার কিছু অংশ মাছের মধ্য দিয়ে মানবদেহে ও পাখপাখালি শরীরে যাচ্ছে। এতে করে প্রাণী দেহে একটা ঝুঁকি রয়েছে।তবে এবিষয়ে গবেষণা শেষ হলে আমরা বহুমাত্রিক সিদ্ধান্ত জানাতে পারবো।

সমন্বতি পোল্ট্রি খামারের সরকারি অনুমোদন আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাবেয়া আসফার সায়মা জানান, প্রাণী সম্পদ ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাথে আলোচনা করে অনিবন্ধিত ও পরিবেশ প্রকৃতি এবং জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিতকারী সমন্বিত পোল্ট্রি খামারে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এদিকে কৃষি ও মৎস্য দপ্তরের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চললেও তা এখনও পর্যাপ্ত নয়। খামারের গঠন ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। পৃথকভাবে মাছ ও পশুপালন, নিয়মিত পানি বিশুদ্ধকরণ এবং রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধ করে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

সমন্বিত খামারে গোপন বিপদ; সুবর্ণচরে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

আপনার মতামত লিখুন