অজস্র কল্পকথার কামরূপ কামাখ্যা দর্শন
আসাম ভ্রমণের প্রস্তুতি থেকেই বারবার মনে আসছিল কামরূপ কামাখ্যার কথা। সেই শৈশব থেকেই এই কামরূপ কামাখ্যা নিয়ে কত কল্পকাহিনি, কত বিশ্বাস-সংস্কারের গল্প শোনা। বাংলাদেশের জাদুকর বা তান্ত্রিকদের মধ্যে বেশিরভাগই নিজের সাধনা বা তন্ত্রশিক্ষাস্থল হিসেবে এই কামরূপ কামাখ্যার কথা বলেন। এমনকি যে বিজ্ঞাপন প্রচার হয়, সেখানেও কামরূপ কামাখ্যার কথা চোখ এড়ায় না। কলকাতা হয়ে আসামের গৌহাটিতে পা রাখার পর থেকেই ঘুরে আসার স্থানের তালিকায় স্বভাবতই ওপরে উঠে এলো কামরূপ কামাখ্যার নাম।
মেঘালয়ের শিলংয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচি ও ঘোরাঘুরি শেষে গৌহাটিতে ফিরতে ফিরতে ডা. যীশুময় দেব যখন বলছিলেন, কামরূপ কামাখ্যায় কে যাবেন, সবার আগেই নিজের হাতজোড়া উঠে গেলো। রাতযাপন শেষে পরদিন ভোরে যাত্রা কামরূপ জেলার কামাখ্যা মন্দিরের পথে। বাইরে এটি কেবল কামরূপ কামাখ্যা হিসেবে পরিচিত হলেও স্থানীয়ভাবে স্থানটি কামাখ্যা মন্দির। নীলাচল পর্বতের ওপরে এর অবস্থান।
উপমহাদেশজুড়ে পরিচিত কামাখ্যা মন্দিরের বড় পূজারি ধরনীকান্ত দেবশর্মা রচিত ‘কামাখ্যা-দর্শন’ বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘ভারতবর্ষে আর্যধর্মের অগণিত তীর্থস্থান আছে। পুরাণ তন্ত্রাদি মতে, ৫১টি মহাপীঠের মধ্যে যুগ যুগ ধরে কামাখ্যা মহাপীঠই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনার জাগ্রত ও পুণ্যতম শক্তিপীঠরূপে বিদিত।’
সেই বইয়েই কামাখ্যা মন্দিরে পূজার্চনা শুরুর ইতিহাস সম্পর্কে বলা আছে, সৃষ্টির প্রারম্ভে সত্য যুগে দক্ষরাজের স্ত্রী বারিণীর গর্ভে জন্ম নেন সতীদেবী। ব্রহ্মার আদেশক্রমে তাকে মহাযোগী শিবের সঙ্গে বিয়ে দেন দক্ষরাজ। বিয়ের পর শিব-সতী কৈলাস শিখরে বসবাস করতে থাকেন। কিছুদিন পরে শিবের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে আমন্ত্রণ না জানিয়েই অন্য দেব-দেবীদের নিয়ে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন দক্ষরাজ। মহাদেব শিবকে এভাবে অপমান করায় সতীদেবী যজ্ঞস্থলে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। সতীর বিয়োগ-যন্ত্রণা সইতে না পেরে তার শবদেহ কাঁধে নিয়ে উন্মত্তের মতো ত্রিভুবন ঘুরতে থাকেন শিব। এতে সতীর দেহ ৫১ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে ভারতভূমির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ৫১ স্থানেই গড়ে ওঠে মহাপীঠস্থান। এমনই এক পীঠস্থান কামরূপ। সতীদেবীর জননেন্দ্রিয় কামরূপের এই পর্বতে পড়লে তা নীলবর্ণ ধারণ করে। সেজন্য এই পর্বতের নাম হয়ে যায় ‘নীলাচল’। আর এই স্থানের অধিষ্ঠাত্রী কামাখ্যাদেবী হিসেবে অভিহিত হন। ফলে এটি কামাখ্যা মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং পূজিত হতে থাকে।’
গৌহাটি থেকে পাহাড়ি পথ বেয়ে অল্প সময়েই গাড়ি পৌঁছে গেলো কামাখ্যা মন্দিরের প্রধান ফটকে। মূল মন্দির প্রাঙ্গণে যেতে জুতো রেখে যেতে হয়। ভেতরে যারা প্রার্থনা-পূজা দিতে চান তাদের রেখে যেতে হয় মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন, ঘড়িও। সঙ্গী ডা. যীশুময় দেব, অভিজিৎ ভট্টাচার্য, মৃণাল বণিক ও সুনীল সিংহ এতদূর এসে পূজা দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। বাকি শাহজাহান মোল্লা, আবু বকর আল আমিনসহ অন্যরা বাইরে জুতো-মানিব্যাগ রেখে মন্দির প্রাঙ্গণে পা বাড়ালেন।
প্রথম ফটক থেকে পাহাড়ি পিচঢালা পথ বেয়ে এগোতেই দেখা যায় হাজারো দর্শনার্থী-পুণ্যার্থীর ভিড়। পুরুষ ভক্তদের বেশিরভাগের পরনে লাল শার্ট, লুঙ্গি ও গামছা। নারী ভক্তদের বেশিরভাগ লাল কাপড় পরে এসেছেন।
মন্দিরমুখী সড়কের দুই পাশে অসংখ্য দোকান। থরে থরে সাজানো কামাখ্যা দেবীসহ বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, রুদ্রাক্ষের মালা, আংটি, বাসন-কোসন, মন্দিরে পূজা দেওয়ার উপকরণ, ফুলের মালাসহ হরেক রকমের স্যুভেনির। যারা পূজা দিতে মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন, তারা পূজার উপকরণ কিনছেন, যারা ফিরে আসছেন তারা স্বজন-শুভানুধ্যায়ীদের জন্য রুদ্রাক্ষের মালা, পিতলের নানা উপকরণসহ উপহার সামগ্রী কিনছেন।
একেবারে মন্দির কমপ্লেক্সে যাওয়ার পর কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ হয়। পূজারির সঙ্গে পূজা দিতে চলে যান যীশুময়-অভিজিৎ-মৃণাল-সুনীলরা। বাকিরা তাদের পিছু পিছুই পা বাড়ান মন্দির প্রাঙ্গণে। ভেতরে ঢুকতেই ধূপ, ফুলের সৌরভ, মোমবাতি ও প্রদীপের গন্ধ এবং পূজারি-দর্শনার্থীদের শোরগোলে মনে হয় এক ভিন্ন জগৎ। থেমে থেমে ঘণ্টার ধ্বনি মনে করিয়ে দিচ্ছিল এটি কামরূপ কামাখ্যা।
অভিনব স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত কামাখ্যা মন্দির। এর চারপাশে বাঁধানো চাতাল। মন্দিরের গায়ে দেবদেবীসহ নানা রকমের মূর্তি ও কারুকার্য। মন্দিরে চারটি কক্ষ। এর মধ্যে একটি গর্ভগৃহ এবং তিনটি মণ্ডপ। গর্ভগৃহটি ভূগর্ভস্থ একটি গুহা, ছোট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। ভেতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে নারীর জননেন্দ্রিয়ের আকৃতির। পাথরখণ্ডটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত হয়ে আসছে।
জানা যায়, মূল মন্দিরের চূড়া সোনায় বাঁধানো। মূল মন্দির লাগোয়া গম্বুজগুলোও বাঁধানো সোনায়। সবমিলিয়ে কামাখ্যা মন্দিরের বড়-ছোট চূড়াগুলো এখন ১৯ কেজি সোনায় সজ্জিত। এই মন্দিরকে এভাবে সোনায় সাজিয়েছেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মুকেশ আম্বানি।
মন্দিরের পূজারিরা পাণ্ডা বলে পরিচিত। বেশিরভাগ পাণ্ডাকে দেখা গেলো ভক্তকূল নিয়ে পূজার আয়োজনে। মন্দিরের ভেতরেই ছাগল ও কবতুরসহ বিভিন্ন পাখির পাল। এগুলো মন্দিরে উৎসর্গ করেছেন ভক্তরা।
গোটা মন্দির চক্কর দিয়ে ঘোরালেন কামাখ্যা মন্দিরের পূজারি মনোজ শর্মা। তিনি আবার গৌহাটির জে বি কলেজ অব হেলথ সায়েন্সের মাইক্রোবায়োলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক। মনোজের পিছু পিছু মন্দির সংলগ্ন একটি জলাশয়ের প্রান্তে যাই। পূজারি মনোজ জানান, এটি সৌভাগ্যকুণ্ড। ভক্তরা এই কুণ্ড থেকে শুদ্ধ হয়ে গণেশ মূর্তি দর্শন করে তবেই কামাখ্যা দেবী মন্দিরে পূজা দিতে যেতে পারেন।
‘কামাখ্যা-দর্শন’ বইয়ে উল্লিখিত তথ্য মতে, কামাখ্যা দেবীর পীঠমন্দির ৫২৫ ফুট উঁচুতে। এখানে পাণ্ডার সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। সেবাইত ও অন্যান্য অধিবাসী আড়াই হাজারের বেশি। পাণ্ডা আর সেবাইতের সংখ্যা হিসাব ধরলেই বোঝা যায়, কেমন সরগরম থাকে কামাখ্যা মন্দির।
মনোজ শর্মা বলছিলেন, প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার ভক্ত আসেন কামাখ্যা মন্দিরে। সরকারি ছুটির দিনে এ সংখ্যা ২০-২৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এখানে আসা ভক্তরা মনোবাসনা ও পুণ্যের আশায় দেবীদর্শন, জীব বলি, পূজাসহ নানা ধরনের অর্চনা করেন। কেউ তান্ত্রিক মনোবাসনা পূরণের আশা নিয়ে এলে সিদ্ধি লাভ করেন। খালি হাতে ফেরেন না।
মনোজ শর্মার সঙ্গে আলাপ শেষ হওয়ার আগেই পূজা দিয়ে বের হন যীশুময়-সুনীলরা। চট্টগ্রামের বাসিন্দা ডা. যীশুময় দেব জাগো নিউজকে বলেন, এই মন্দিরের সঙ্গে আমাদের প্রজন্মান্তরের সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধকালে একটা সময় আমার বাবা এই মন্দিরে অবস্থান করেছিলেন। বাবার সেই স্মৃতিবিজড়িত মন্দিরে এসে পূজা দিতে পারায় এক ভালো লাগা কাজ করছে।
তরুণ দর্শনার্থী মৃণাল বণিক বলেন, এই মন্দিরে পূজা দিলে মনোবাসনা পূরণ হওয়ার কথা শৈশব থেকে শুনছি। এবার আসাম এসে কামাখ্যা দেবীর দর্শনের সুযোগ হলো। নিজের, পরিবারের, সমাজের সর্বোপরি দেশের ও মানবতার কল্যাণ হোক- এই প্রার্থনা করেছি পূজায়।
তন্ত্রমন্ত্রের কল্পকথা শুধুই গল্প!
মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে বেরোনোর বেলায় সেই কল্পকথাই বারবার মনে পড়ছিল। কামরূপ কামাখ্যায় নাকি জাদুবিদ্যায় পারদর্শী অনেক তান্ত্রিক থাকেন, যারা এখানে আসা লোকজনের জীবনকে নিজেদের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এখানে নাকি অনেক যোগিনী থাকেন, যারা পুণ্যের আশায় আসা সুদর্শন পুরুষদের তন্ত্রবলে বশ করে যৌনদাস বানিয়ে ফেলেন। সেই পুরুষরা কোনোক্রমে ওই বশের কবল থেকে বেরোতে পারলেও তাদের যৌবন রেখে আসতে হয় কামাখ্যায়। এখানকার তান্ত্রিকদের অনুসারীরা জগৎজুড়ে তন্ত্র-মন্ত্রে অনেককে বশ করে ফেলছেন, অনেকের মনোবাসনা পূরণ করে ফেলছেন।
কোথায় সেই তান্ত্রিক-যোগিনীরা? জানতে চাইতেই এক পূজারি হেসে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ধর্মে নয় শুধু, এখন বিজ্ঞানেও ধ্যান-মেডিটিশনের কথা বলা হয়। কামরূপের এই নীলাচল পাহাড় আগে এতটা সরব ছিল না। তখনকার পরিবেশ ধ্যানের জন্য অনেক বেশি উপযোগী ছিল। অনেক পূজারি দীর্ঘদিন ধরে ধ্যান করতেন বলে তাদের নিয়ে নানান কল্পকথা ছড়ানো হতে থাকে, সেগুলোই ধীরে ধীরে রূপ নেয় তন্ত্র-মন্ত্রের রহস্যকথায়। তবে সেই ধ্যানও এই মন্দিরে হতো না, মন্দির থেকে দূরে পাহাড়ি এলাকা ও শ্মশানঘাটে হতো। এখনো দূরের নির্জন পাহাড়ি এলাকায় এ ধরনের সন্ন্যাসীর দেখা মেলে। তবে তারা কামাখ্যা মন্দিরের পূজারি বা কেউ নন।
গৌহাটি ফিরতে ফিরতে শাহজাহান মোল্লা বলছিলেন, দূর থেকে কল্পকথা যত রহস্যময় হয়, কাছে এলে বাস্তবতা ততই স্পষ্ট হয়। কামাখ্যা মন্দির কত কথাই স্পষ্ট করে দিলো।
লেখক: সাংবাদিক
আপনার মতামত লিখুন