উনাবাতুনা- পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকত
লেখক উদয় হাকিমের সঙ্গে তাঁর সহকর্মী ফিরোজ আলম এবং মিল্টন আহমদ
পুরো শ্রীলঙ্কা হচ্ছে একটি দ্বীপ। একটি দ্বীপ নিয়ে একটি দেশ। চারদিকে ভারত মহাসাগর। সাগরের মাঝখানে সুন্দর একটি দ্বীপ। যার আদি নাম সিংহল। এখানকার বাসিন্দাদের বলা হতো সিংহলিজ। এদের জাতীয় প্রতীক সিংহ, পতাকায় আছে তলোয়ার হাতে সিংহ।
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট সিরিজ উপলক্ষে শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলাম। মাঝখানে একদিনের বিরতি। কি করা যায়? ভাবলাম কোনো একটা বিচে ঘুরে আসি। এর আগে বেনটোটা নামে একটা সৈকতে গিয়েছিলাম। খুব নিরিবিলি। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকরা সেখানে বেশি যায়। নিভৃতে সৈকত উপভোগ এবং লালচে বালিতে রোদ বিলাস, বইপড়া কিম্বা ভলিবল খেলার জন্য দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় বেনটোটা বেশ বিখ্যাত। বছর ছয়েক আগে ক্রীড়া সাংবাদিক এমএম কায়সার ওই বিচের খবর দিয়েছিলেন। ঢাকা ব্যাংকের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার বজলে রশিদ এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম বেনটোটা। যাক সে কথা আরেক দিন বলা যাবে।
সহকর্মী ফিরোজ আলম এবং মিল্টন আহমদ বললো চলেন গল যাই। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে সুন্দর এবং ঐতিহ্যবাহী শহর হচ্ছে গল। সেখানকার ক্রিকেট মাঠ বেশ বিখ্যাত। আমার কাছে গলের কথা মনে আছে আরেকটি কারণে। ২০০৪ সালে প্রলয়ঙ্করী সুনামিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিলো গলের। বিশেষ করে গলের ক্রিকেট গ্রাউন্ড ভেসে গিয়েছিলো উত্তাল জলস্রোতে। গল ফোর্ড বা দূর্গ ডুবে গিয়েছিলো পানিতে। উপকূল হয়েছিলো লন্ডভন্ড। ওই সুনামিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিলো ইন্দোনেশিয়ায়। তারপরেই শ্রীলঙ্কা।
ইন্টারনেট ঘেঁটে ফিরোজ আলম বললেন, গলে খুব চমৎকার একটা বিচ আছে। এটি নাকি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিচ। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, চলেন ঘুরে আসি।
সকালে নাস্তা সেরেই রওনা হলাম। কলম্বো থেকে গল পর্যন্ত ট্রেন লাইন আছে। এই ট্রেন লাইনটিও বিখ্যাত। কেন? শ্রীলঙ্কার পশ্চিম প্রান্তের সাগর ঘেঁষে কলম্বো থেকে গল গেছে এই লাইন। কখনো একপাশে সাগর, আরেক পাশে পাহাড়। যেটি সব মানুষকেই আকর্ষণ করে।
স্টেশনে গিয়ে সহজেই ট্রেন পেয়ে গেলাম। মিনিট পাঁচেক পরেই ট্রেন পায়ের কাছে হাজির। ট্রেন চলতে শুরু করলো। সমুদ্রের তীর ধরে একটানা পথ। সাগরের বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। নীল জলের ফেনিল সফেদ উদ্দামতা সশব্দে লুটিয়ে পড়ছে ট্রেনের নিচে। প্রায় সব যাত্রী সেদিকে তাকিয়ে। যারা নিয়মিত যাতায়াত করে কেবল তারাই অন্যমনস্ক।
মাঝপথে একটা স্টেশন পড়লো। নাম হিক্কাতোয়া। সেখানে মিল্টন আর ফিরোজ ট্রেন থেকে নেমে গেলো। এরা দুজন ছবির পোকা। যেখানেই যাক, ছবি মিস নেই। মরচে রঙা ট্রেনের সঙ্গে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে আপ। বাপরে বাপ!
তিন ঘন্টা লাগলো গল রেল স্টেশনে পৌঁছতে। একেবারে সাদামাটা স্টেশন। বলার মতো তেমন কিছু নেই। তবে অনেক পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী মনে হলো। ট্রেনের ভেতেরই ফিরোজ আলম স্থানীয় একটি কলেজের এক অধ্যাপকের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি আবার ট্যুরিজম কর্তৃপক্ষের প্রশিক্ষকও। স্টেশনে থেকে বেরোনের পর একটা টুকটুকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ওই অধ্যাপক। স্থানীয় ভাষায় একটা মোটা কাগজ চেয়ে নিলেন। তার মধ্যে গলের পর্যটন স্পটগুলোর ছবি এবং দূরত্ব দেয়া ছিলো। বললেন, যেখানেই যান মিটারে প্রতি কিলো ৯০ রুপি ভাড়া উঠবে। যেটুকু সময় ঘুরবেন তার জন্য কোনো বিল দিতে হবে না। ফিরোজ আলম আমার দিকে তাকালেন। তার মানে আমরা কি করব? বললাম, আমরা ওই বিচে নেমে যাই। পরে আবার আরেকটা টুকটুক নিয়ে চলে আসব।
সম্রুদ্রের পাড় ঘেষে চলছিলো টুকটুক। একটা জায়গায় নাকে উৎকট গন্ধ আসলো। মাছ বাজার। সাগর থেকে মাছ ধরে জেলেরা ওই বাজারে বিক্রি করেন। তীরে বাঁধা অসংখ্য জেলে নৌকা। ঢেউয়ের জলের থাবা থেকে রাস্তা বাঁচাতে উঁচু করে গাইড বাঁধ দেয়া। তবু ঢেউয়ের ছাঁট গিয়ে প্রায়শ রাস্তায় পড়ে। ভেজা রাস্তা দেখে সহজেই সেটি অনুমান করা যাচ্ছিলো।
মাছ বাজারের পরেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো খুব সুন্দর সুখ জাগানিয়া ছোট্ট শহর। বা দিক থেকে ঢুকে গেছে সমুদ্রের ভেতরে। এমন একটা শহর, বসবাসের জায়গা মানুষ কেবল কল্পনা বা স্বপ্নে দেখে। কিছু মানুষের ভাগ্যে জোটে। ওখানে যারা বাস করছেন তারা নিশ্চয় ভাগ্যবান!
শহরের ভেতর দিয়ে টুকটুক গিয়ে থামলো একটা ভবনের নিচে। কাছেই সমুদ্র। বিশাল ঢেউ, পরিচিত কলতান। দক্ষিণ দিক খোলা। দখিনা খোলা হাওয়া জুড়িয়ে দিচ্ছিলো শরীর। পূর্ব পশ্চিমে লম্বা সৈকত। উত্তর দিক দিয়ে অনেক হোটেল মোটেল রিসোর্ট। বালি মাড়িয়ে যাচ্ছিলাম জলের কাছে। বালুর মধ্যে কিছু সাদা রঙের বিদেশি চিৎ হয়ে শুয়ে। কেউ বই পড়ছিলো, কেউবা উপুড় হয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলো।
এক ফ্রেমে আমাদের তিনজনের ছবি তোলার দরকার। কাকে ডাকব ভাবছিলাম। এমন সময় পরিচিত এক ভদ্রলোক গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আমাদের দিকে আসছিলেন। তিনি রনি ভাই। ক্রিকেট বোর্ডে কাজ করেন। কি ব্যাপার রনি ভাই? আপনি এখানে?
রনি ভাই হাসলেন। পাশের একটি হোটেলে উঠেছেন। ড্রেস চেঞ্জ করে সমুদ্র স্নানে যাচ্ছিলেন। উনি কে..? বললেন, আপনার ভাবি। মিল্টন মজা করলেন, আগেরবার তো আরেকজনকে ভাবি বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ভাবিও হাসলেন। রনি ভাই আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছিলেন। ভাবি তার কাছ থেকে মোবাইল কেঁড়ে নিয়ে বললেন, আমাকে দাও। আমার ছবি সুন্দর হয় বেশি।
ওনাদের সুযোগ দিয়ে উনাবাতুনার অন্য দিকে গেলাম আমরা। ও হ্যাঁ, এই সৈকতের নাম উনাবাতুন। স্থানীয় উচ্চারণ ওরকমই। যদিও ইংরেজিতে লেখা উনাউয়াতুনা। এটা বললে আরব্য সৈকতের মতো মনে হয়! কে যেন বলছিলো, সৌন্দর্য্যের দিক থেকে এটি বিশ্বে ১২ তম। সেরকম কোনো তথ্য অবশ্য খুঁজে পাওয়া গেলো না। তবে নি:সন্দেহে এটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে সুন্দর বিচ। প্রচুর পর্যটক আসেন এখানে।
অন্য সমুদ্র সৈকতের চেয়ে এর কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। দূরে দেখা যাচ্ছিলো বিশাল পাথরের খন্ড। সেখানে ঢেউগুলো বাড়ি খাচ্ছে। সাদা ফেনার মতো জলগুলো ঝলসে উঠছে। নৌকা বা জাহাজ সেখানে ভেড়া মুশকিল। পাথরে আটকে বা জোরে আঘাতে ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই হালকা স্পিডবোট চলে বেশি।
মূল গল শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূবে এই সৈকত। এটি একটি প্রবাল বিচ। কলম্বো থেকে দূরত্ব ১০৮ কিলোমিটার। যাওয়া যায় ট্রেনে কিম্বা বাসে। নিজস্ব গাড়ি থাকলে ভালো। নারকেল বাগান আর নীল সাগরের ঢেউ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।
বিচ এলাকায় কিছু বানর দেখা গেলো। রক্তবর্ণমূখী লাজুক বানর বা লেঙ্গুরের জন্য গল পরিচিত। আশপাশের বনাঞ্চলে এরা বাস করে। লেঙ্গুরের ওই প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। আমরা যদিও ও রকেমর বানর দেখি নি। তবে অ্যাডামস পিক এ যাওয়ার পথে রক্তমুখা বানর দেখেছিলাম রাস্তার ধারে। ওদের মুখমন্ডল সত্যিই বেশ আকর্ষণীয়।
নেট ঘেঁটে দেখা গেলো, বাল্মিকির মহাকাব্য রামায়নেও ওই উনাবাতুনা সৈকতের কথা উল্লেখ আছে। যাতে বলা হয়েছে, এলাকাটি জঙ্গলাকীর্ণ। নারকেল সারির জন্য জায়গাটি বিখ্যাত। এ বনাঞ্চলে স্বর্গীয় সঙ্গীত পরিবেশনকারী, ধ্যানী এবং সন্যাসীদের বসবাস ছিলো। এখানে নাকি অনেক স্বর্গীয় প্রাণীও বাস করতো। সবচেয়ে মজার তথ্য হলো, রাক্ষসরা উনাবাতুনা সৈকত পাহারা দিতো!
সম্ভবত রাক্ষসদের চলাচলের জন্য সৈকতের কাছাকাছি পানিতে বড় বড় কঠিন পাথরের উপস্থিতি রযেছে। যা চোখে পড়ার মতো। সৈকতের পশ্চিম দিকটা সাগরের অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে। হয়তো রাক্ষসেরা পাথর ফেলে ফেলে সমুদ্রের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো। যেমনটা দেখা যায় উত্তর আয়ারল্যান্ডের জায়ান্ট কজওয়েতে।
রাবণের আস্তানা থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছিলেন লক্ষণ। তাকে বাঁচাতে হিমালয় থেকে হুনুমান এসেছিলেন ওই উনাবাতুনাতে। এই রাবণ রাজত্ব থেকে জম্বুবান, মৃতসঞ্জীবনী, সুবর্নাকারী এবং সন্ধনী নামে চার রকমের ওষুধি গাছ নিতে হিমালয়ে পাঠানো হয়েছিলো হুনুমানকে। হুনুমান সঠিক গাছ বাছাই করতে না পেরে পুরো পর্বতই নাকি নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই পর্বত তুলে নেয়ার পথে এর কিছু অংশ নাকি এই উনাবাতুনাতে পড়ে গিয়েছিলো। এজন্য জায়গাটার নামকরণ এরকম। উনাবাতুনা মানে ‘যা নিচে পড়েছে‘।
ইন্টারনেটে পেলাম আরেকটি তথ্য। এখানে পুমা নামে একটি প্যাগোডা বা বৌদ্ধ উপাসনালয় আছে। মহাযান সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ জাপানি সন্যাসীরা এখানকার সাগর তীরবর্তী পাহাড়ে হুনুমান দেবের সম্মানে একটি ঘর তৈরি করেছেন। সময় স্বল্পতায় পশ্চিম পাশের ওই উপাসনালয়ে আমরা যেতে পারিনি। যাইনি আরেকটি কারণে। কোথাও কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় আমাকে টানে না। এই বিষয়টির প্রতি কেন জানি না আমার ভীষণ অনীহা, অপছন্দ।
পুরনো কাহিনী থেকে এই উনাবাতুনার আরো অনেক গল্প রয়েছে। [চলবে]
আপনার মতামত লিখুন