গল ফোর্ট: শ্রীলঙ্কার আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল
খোলা তীর। মাতাল সাগর। উচ্ছল ঢেউ। জলতরঙ্গ সুর। সুনীল আকাশ। রূপোলী জল। ফেনিল পানি! পাথুরে সৈকত। পোড়া মাটির দূর্গ, পোড়ো বাড়ি। লাগোয়া সবুজ ক্রিকেট মাঠ। এই হলো গল।
গল নামটি বেশ বিখ্যাত। ক্রিকেট প্লেয়িং ন্যাশনগুলোর মধ্যে একটি পরিচিত নাম, ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে। সৌন্দর্য বিচারে গলের ক্রিকেট মাঠ খুবই জনপ্রিয়। বহুবার সাংবাদিক এবং ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের মুখে নাম শুনেছি। এর আগে দু’বার শ্রীলঙ্কা গিয়েছি। কিন্তু গল যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তাই তৃতীয়বারে মিস করতে চাই নি। শ্রীলঙ্কা যারা যাবেন আসলে তাদের কারোরই গল মিস করা ঠিক হবে না।
কলম্বো থেকে ট্রেনে গিয়েছিলাম। সময় লেগেছিলো ঘন্টাতিনেকের মতো। কলম্বো থেকে গল দেড়শ’ কিলো। প্রথমেই গিয়েছিলাম উনাবাতুনা বিচে। যার বিশেষত্ব হলো সৈকতের লালচে বালু আর শান্ত নির্জন পরিবেশ। সেখান থেকে একটি টুকটুক (স্কুটার) নিয়ে গল ফোর্ট। বাংলায় বললে গল দূর্গ।
দূর থেকেই দূর্গের সুউচ্চ টাওয়ার চোখে পড়ে। টাওয়ারের কপালে একটা ঘড়ি, সুন্দরী ললনার টিপের মতো। দূর্গের ঠিক মাঝখানে ওই টাওয়ার। তার চারপাশে অতি প্রাচীন স্থাপনা।
দূর্গের তিন দিক সমুদ্র, জলভাগ। কেবল উত্তর দিকটায় স্থল বা মাটি। আমরা টুকটুক থেকে নেমে হাঁটি। মূল গেটের ডান পাশে বাস স্টপ। দর্শনার্থীরা তাদের যানবাহন রাখতে পারেন সেখানে। যদিও তার খানিটকা উত্তর পশ্চিমেই বাস স্টেশন। মূল গেইটের বাইরে কোনো নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই, নেই কোনো নিরাপত্তা রক্ষী। উত্তর পাশে মূল গেট। অনেকটা মাটির বড় সুড়ঙ্গের মতো মূল গেইট পার হয়ে ভেতরে গিয়ে চোখ পড়লো একজন মাত্র নিরাপত্তারক্ষীকে। অলস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি, ফিরোজ আর মিল্টন, তিনজনের গায়ের রঙই শ্রীলঙ্কানদের মতো। তাই একটা ক্যাজুয়াল লুক দিয়েই লোকটি অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালেন।
ভেতরে প্রবেশ করেই দেখলাম অনেকটা খোলা জায়গা। বা পাশে ভলিবল খেলার মাঠ। ডান পাশটা ফাঁকা। দক্ষিন দিকে রাস্তা। সেটি ধরে যাওয়া যায় একেবারে সাগরের তীর পর্যন্ত। এক সময় যে জায়গা শাসকদের কড়া পাহারায় তটস্থ ছিলো, এখন সেটি অরক্ষিত এক নগরী। দূর্গের ভেতরে এখন অসংখ্য বাড়িঘর, দালান কোঠা। আছে মসজিদ, মন্দীর, প্যাগোডা। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পানশালা সবই।
আমার দৃষ্টি ছিলো উপরে। অনেক দূর থেকে দেখেছিলাম মানুষ জনকে দূর্গের উপর দিয়ে হাঁটতে। উপরে উঠার বেশ কিছু সিঁড়ি ছিলো। এরমধ্যে কিছু খুব পুরনো এবং গোপন পথ। দুই সহকর্মী মিল্টন আর ফিরোজ আলম বাইরের পথ দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। আমি একটা গোপন পথ ধরে উঠলাম। ঠিক দোতলা বলা চলে না; উপরে গেলে মনে হবে সেটিই নিচতলা। বিশাল এক ইট পাথরের চত্বর। রাজকীয় কারবার। দোতলার উপরে ঘাস মাটি জমে ছিলো। অনেকটা ফসলের মাঠের মতোই। স্থাপনার বীমগুলো ক্ষেতের আ’লের মতো দেখাচ্ছিলো। উত্তর বা গল স্টেডিয়ামের দিকে দেয়াল পুরনো এবং দাঁত বের করা রঙচটা ইটের নিচু দেয়াল। ঠিক দেয়াল বলা চলে না। সম্ভবত প্রহরীদের দাঁড়ানোর জায়গা ছিলো। যাতে বাইরে থেকে তাকে কেউ দেখতে না পায়। প্রহরীদের গায়ে কোনো গুলি না লাগে। খুঁপড়িগুলো উত্তর দিকে হাঁ হয়ে ছিলো। সেগুলো এখন কপোত কপোতীর খুঁপড়ি। সবাই বসে ছিলো জোড়ায় জোড়ায়। আহা, এই শ্রীলঙ্কাতেও ওদের এতো জায়গা সঙ্কট। মনে হচ্ছিলো, সারা দুনিয়াতেই প্রেমিক প্রেমিকার জন্য এতোটুকু নিরাপদ জায়গা নেই। নিজেকে আড়াল করার কত চেষ্টা তাদের। আড়াল কোথায়? তাদের অভয়ারণ্য কোথায়?
একেবারে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে চলে গেলাম। সেখান থেকে সমুদ্রের রূপটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। বিশেষ করে মাছধরা নৌকোগুলো তীরে আসছিলো। জোড়ালো হাওয়ায় কাঁপছিলো সাগরের জল। ঢেউয়ের তোড়ে দোলছিলো নৌকো। সূর্যটা ততক্ষণে পশ্চিমে ঢলে পড়েছিলো। রোদটা মুখে লাগছিলো। ছবি খুব ভালো আসছিলো। ফিরোজ আলম আর মিল্টন আহমেদ ব্যস্ত হয়ে গেলেন ছবি তুলতে। পূর্ব পাশে দেয়াল ছিলো না। পুরোটাই ফাঁকা। দেখা যাচ্ছিলো উনাবাতুনা সৈকতের পশ্চিমের স্থাপনাগুলো। উনারা দুজন যখন ছবি তোলায় ব্যস্ত, আমি তখন খেয়াল করছিলাম আরেকটি বিষয়। পূর্ব পাশের সীমানা দেয়াল ছেড়ে বিশাল আরেকটা দেয়াল। সেটি দক্ষিণে চলে গেছে অনেক দূর। দেয়ালটা অনেক চওড়া। এর উপর দিয়ে অনায়াসে দৌড়ানো যাবে। তবে কি দূর্গের প্রহরীরা এই দেয়ালের উপর দিয়ে নিরাপত্তা তদারকি করতো! ওই চওড়া দেয়ালে উঠে কিছুদূর হেঁটে গেলাম। কেউ বাঁধা দিচ্ছিলো না। ইচ্ছে করলে এটা দিয়ে হেঁটে দক্ষিণে অনেক দূর যাওয়া যেতো। মিল্টকে ইশারা করতেই সে ডিএসএলআর এর চোঙা তাঁক করলো আমার দিকে। ছবি তোলা শেষ হলে সে-ও গিয়ে দাঁড়ালো রাজকীয় প্রাচীরে।
উত্তর পাশের দূর্গের দ্বিতীয় তলার শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলতে চাইলাম। পেছনে গল স্টেডিয়াম রেখে। মাঠে তখন খেলা হচ্ছিলো। সাদা পোশাকের। হতে পারে চারদিনের ম্যাচ। ক্রিকেট এখানে খুব জনপ্রিয়। এই শ্রীলঙ্কা ওয়ানডে ক্রিকেটের চ্যাম্পিয়ন ছিলো।
কোথাও ফাঁকা জায়গা পাচ্ছিলাম না। সবগুলো গ্যাপ ছিলো তরুণ তরুণীদের দখলে। পশ্চিম দিকে একটা জায়গা ফাঁকা পেলাম। সেখানে বড় আকারের কামানের মতো সিমেন্টে বাঁধানো একটা অর্ধগোলাকৃতির নালা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। সামনে ছিলো ঢালু ঘাসময় একটা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। দেখলাম, স্টেডিয়ামকে পেছনে রেখেছবি তুলতে হলে যেতে হতো আরো পশ্চিম দিকে।
দূর্গের পূর্বাংশ থেকে হেঁটে মাঝের অংশে যাচ্ছিলাম। কিছু লোক কাজ করছিলো। সংস্কার কাজ হচ্ছিলো দূর্গের। তারা খুব আস্তে ঘষছিলো কংক্রিটের স্থাপনা। হ্যাঁ, মাঝের জায়গাটা পুরোটাই ফাঁকা। যদিও দোতলায় উত্তরের শেষ সীমায় কোনো রেলিং নেই। নেই দূর্গের কোনো অংশেই। নিচে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিলো। মূল স্থাপনা যদিও দুই ধাপে সাজানো। তারপরও এতো উঁচু থেকে পড়লে হতে পারে মৃত্যুও।
তখনো খেলা চলছিলো স্টেডিয়ামে। গল স্টেডিয়ামে গ্যালারি বলতে ছোট্ট একটা জায়গা। অল্প কিছু লোক বসতে পারবে। বাকি জায়গা ফাঁকা। চারদিকে লোহার শিক দিয়ে ঘেরাও।
দূর্গেরমাঝের অংশের পাশেই অনেক বড় পার্কিং এরিয়া। বিভিন্ন স্কুল থেকে স্টুডেন্ট আর টিচাররা এসেছিলেন, বাসে উঠছিলেন। বোঝা গেলো নিয়মিত লোকজন যান দূর্গ দেখতে।
আগেই বলেছিলাম, মাঝখানে বিশাল টাউয়ার; ক্লক টাউয়ার। উপাসনালয়ে লম্বা গম্বুজের মতো উঠে গেছে সুদূর শুন্যে। তার উপরের দিকটায় ঘড়ি বসানো। অনেক দূর থেকে ঘড়িটি দেখা যায়। টাইম ঠিক ছিলো কি না মিলিয়ে দেখিনি। এই ঘড়িগম্বুজের উত্তরে একটা বাঁধানো জায়গা, হেলিপ্যাড। সেখান থেকে উত্তরের রাস্তা আর খেলার মাঠ আরো ভালো দেখাচ্ছিলো। ওই অংশের ঢালু পথ ধরে দোতলা বরাবর নিচে নামতেই চোখে পড়লো দেয়াল ঘেঁষে পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে। তারা জীবন্ত নয়, মূর্তী সেপাই। ব্রোঞ্জের তৈরি। হাতে বন্দুক। এই বন্দুকের আবিষ্কারই হয়তো পৃথিবীকে এতোটা বিষাদময় করেছিলো, করছে। তার ঠিক নিচেই একটা স্যুভেনিরের দোকান। পর্যটক কম বলে দোকানি অলস ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। ক্লক টাওয়ারের নিচের জায়গায় পশরা সাজানো। পণ্য তেমন কিছু নেই। যেমন হাতি, বুদ্ধ মূর্তি এসব। কিন্তু একটা দোকান বলেই কি না, দাম আকাশ চুম্বী। মনোপলি ব্যবসার ছোট নমুনা! দাম শুনেই দৌড়ে পালালাম। হাতি শ্রীলঙ্কার জাতীয় প্রতীক। শক্তি আর সৌভাগ্যের প্রতীক।
চলে গেলাম একেবারে পশ্চিমে। পশ্চিম দিকটাও সাগরমুখী। সময়টা ছিলো বিকেল। সূর্য একেবারে হেঁলে পড়েছিলো সাগরের জলের দিকে। আর ঠেউয়ের কারণে জলগুলো ঝিলিক মারছিলো। সংস্কার কাজ চলছিলো বলে সেখানটায় বেশিক্ষণ দাঁড়ালো গেলো না। পশ্চিমে এবং পূর্বদিকে দেখছিলাম মজবুত দেয়ালের পরেই নিচু জায়গা। তারপর আরেকটা দেয়াল। পরিখার মতো। যাতে জলদুস্য বা দূর্গ দখলকারীরা প্রথম দেয়াল টপকে দুই দেয়ালের মাঝখানে গিয়ে আটক যায়। মানুষ মারার কত রকমের কৌশল!
পশ্চিম পাশে থেকে বিশাল সিঁড়ি নিচে নেমে গিয়েছিলো। দক্ষিণে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও অনেক চওড়া সীমানা দেয়াল। বেশ শক্তিশালী। কারণ দুটো: প্রহরীদের তদারকি এবং উত্তাল সাগরের ঢেউ, জলোচ্ছ্বাস থেকে দূর্গকে রক্ষা করা।
পশ্চিম পাশটায় সবুজের চিহ্ন নেই। ন্যাড়া পথ। মাঝবরাবর সীমানা দেয়ালের বাইরে ওই সেই দীর্ঘ কবর, সমাধি। এতো লম্বা কবর অনেকটা অবাস্তব। এতোটা লম্বা মানুষ কি পৃথিবীতে আদৌ ছিলো। উনাবাতুনা সৈকতের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলাম এক যুবরাজের কথা। দেবীর রোষানলে পড়ে তিনি সেখানে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। পরে ওই দ্বীপেই বাস করছিলেন। মানুষের উপকার আর উপাসনা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন তিনি। হয়তো তারই সমাধি সেটা। ওই সমাধি ঘিরে ছোট্ট একটা স্থাপনাও দেখেছিলাম।
মিল্টন আমাকে ডেকে নিয়ে দেখালো আরেকটা জায়গা। সে বলছিলো, দূর্গের পশ্চিম পাশে সাগর তীর ধরে একটা স্থানে বড় বড় কচ্ছপ থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামির মাজারের সঙ্গে মেলাতেও পারেন। ওই মাজারের জলাশয়েও বড় আকারের প্রচুর কচ্ছপ থাকে। গল দূর্গের ওই কচ্ছপ অবশ্য বধ্যজলের নয়, খোলা এবং নোনা জলের। আকারে নাকি এগুলো আরো বড়। মিল্টন আরো বলছিলো, সে পাথরের উপর ওই কচ্ছপ দেখেছিলো আগেরবার। যেগুলো ওখানে গিয়ে ডিম পারে। আমরা যদিও কচ্ছপ পাইনি। তবে জানলাম, কচ্ছপ প্রজননের জন্য গল দূর্গ সংলগ্ন ওই জায়গাটি বেশ পরিচিত। কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে গিয়ে দেখেছিলাম কচ্ছপের আস্তানা। সেখানেও ডিম পারার জন্য কচ্ছপেরা ডাঙ্গায় যেতো। দূর্গের পশ্চিমের দেয়াল ঘেঁষা ওই জায়গাটায় ঢেউ কিছুটা কম। অনেকটা জায়গা পাথর বালুতে একাকার। আবর্জনা নেই। একটা ছোট্ট সাইনবোর্ড দেখলাম। শ্রীলঙ্কান ভাষায়। বোঝা গেলো সেখানে কচ্ছপকে বিরিক্ত না করার নিদের্শাবলী থাকতে পারে। পশ্চিম থেকে দক্ষিন দিকে সাগরের তীর ধরে অনেক লম্বা পথ। পুরো পথটার কোথাও কোনো গাছপালা নেই।
পশ্চিম দিকটাতেও কপোত কপোতীর উপস্থিতি ছিলো। আমাদের দেখে তাদের কেউ কেউ লজ্জা পাচ্ছিলো। রাস্তা থেকে দক্ষিণে একটা খাদের মতো পাথুরে জায়গায় প্রেমিক প্রেমিকা ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছিলো। ছাতার আড়াল থেকে মুখ বের করে আমাদের দেখলো। আবারো শামুকের মতো এমনভাবে ছাতার নিচে তারা গুটিয়ে গেলো যে, ভেতরে কেউ ছিলো বলেই মনে হচ্ছিলো না। ছবিয়ালদের আকর্ষণ তাতে বেড়ে গেলো। বুঝতেই পারছেন আমার সঙ্গে তখন দুজন ফটোগ্রাফার যুবক ছিলো। তারা তখন কি করলো?
দূর্গের দক্ষিন পশ্চিম কোণটি আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগলো। দুই চওড়া দেয়াল যেখানে মিশেছিলো তার উপরে বসার সুন্দর জায়গা আছে। ওই কোণে সীমানার বাইরে বিশাল উচু একটা পাথর। সেটি দূর্গের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ওখান থেকে ঘড়ি টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো সাগরের জাহাজগুলোকে সময় জানাতেই কি ওই ঘড়ি সেট করা হয়েছিলো? বাতিঘরের মাথায় ঘড়িঘর?
ওই যে বিশালাকার পাথরের কথা বলছিলাম, সেটি অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো। খাঁড়া সীমানা দেয়ালের নিচে বড় বড় ঢেউ গিয়ে আঁছড়ে পড়ছিলো। স্বচ্ছ জলে নিচের পাথরগুলো চক চক করছিলো। আর সমুদ্রের ফেনাগুলো পাথরগুলোকে যেন দুধে ধুয়ে দিচ্ছিলো। পশ্চিমে যতদুর চোখ যাচ্ছিলো শুধু পানি আর জল। দক্ষিণেও তাই। দক্ষিন পূব কোনে কিছু উঁচু পাথর খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সমুদ্রের জাহাজগুলোর জন্য খুবই বিপজ্জনক। রাতের আঁধারে ওই বিশাল উঁচু ধারালো পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেলে বড় বিপদ ঘটে যাবে। যাহোক আমরা নিজেকে সাবধানে রেখে অনেকগুলো ছবি তুলছিলাম সেখানে। অমন জায়গায় আর কখনো যাওয়া হবে কি না কে জানে?
প্রথমে ভেবেছিলাম খুব অল্প জায়গার উপর ছোট একটা দূর্গ। দক্ষিন পূব কোণ থেকে পূর্ব দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল দূর্গ। অনেক বড় এরিয়া নিয়ে। ৩৬ একর জায়গা সেখানে। তবে এই দূর্গের প্রধান আকর্ষণ আমার কাছে মনে হলো এই সীমানা দেয়াল। এতো মজবুত এবং বিশালাকার দেয়াল আর কোথাও দেখিনি। অনেকটা চীনের প্রাচীরের লঙ্কান সংস্করণ বলা চলে। সমুদ্রের বিশাল ঢেউ, জলোচ্ছ্বাস থেকে দূর্গকে রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিলো। যদিও ২০০৪ সালের মহা সুনামিতে ভেসে গিয়েছিলো দূর্গ; মানে ডুবে গিয়েছিলো। ভাবছিলাম যখন পর্তুগীজ, ওলন্দাজ আর ইংরেজরা এই দূর্গের দখলে ছিলো তখন এরকম সুনামি হলে কি হতো! সুনামির পর চেষ্টা চলছিলো দূর্গকে আগের রূপে ফিরিয়ে নিতে। বছরের পর বছর ধরে মূলত সেই কাজই চলছিলো। কিন্তু অমন দূর্যোগের কোনো সমাধান আসলে নেই। আগের রূপে ফিরিয়ে নেয়া কোনো দিনই সম্ভব নয়।
গল দূর্গের ইতিহাসটা সংক্ষেপে জেনে নিই। শেষ থেকে শুরু করি। এটি ইউরোপীয়দের তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। ইতিহাসবেত্তা যারা তারা বলেন, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক স্থাপনা। বাণিজ্য করেতে এসে তারা ঘাঁটি গেড়েছিলো। উড়ে এসে জুড়ে বসা। যার জায়গা তাকে মেরে তাড়ানোর মতো ব্যাপার। সত্যি বলতে কি, ইতিহাস আমাকে টানে না। কারণ ইতিহাস মানেই মানুষ হত্যার ফিরিস্তি। অমানবিকতার নিদর্শন। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই দূর্গ।
ইউরোপের দেশ পর্তুগাল। ওই দেশের লোকদের বলা হতো পর্তুগিজ। পর্তুগিজ নাবিক বা ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার প্রয়োজনে গলে গিয়ে আস্তানা গড়েন। ১৫৮৮ সালে তারা ওই দুর্গ নির্মাণ করে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়েছে এটি নির্মাণে। এই অর্থ তারা সেই অঞ্চল থেকেই কেড়ে নিয়েছিলো। দূর্গ নির্মাণে কাজ করেছেন গরীব আফ্রিকান আর অসহায় লোকদের বিশাল বাহিনী। পর্তুগিজরা ৫০ বছর এর দখল ধরে রাখেতে পেরেছিলো। এরপর এটি দখল করেছিলো ওলন্দাজরা।
মনে পড়ছিলো, সপ্তম শ্রেনীর সমাজ বইতে পড়েছিলাম এরকম শব্দ। ভাস্কো দা গামা, কলম্বাস, ওলন্দাজ এসব শব্দ বহুশুনেছিলাম। যদিও বুঝেছিলাম খুব কম। বড় হয়ে ভাবছিলাম ওলন্দাজ আসলে কারা? খোঁজ নিয়ে দেখলাম ডাচ বা নেদারল্যান্ডের লোকদের বলা হতো ওলন্দাজ! আমার আন্দাজও ছিলো না এটা। কত প্যাঁচ দেখুন, ওই দেশের আরেক নাম হল্যান্ড। গুরুত্বপূর্ন দুটি প্রদেশের নামানুসারে অনেকে ওই দেশকে হল্যান্ড বলে। তাদের জাতির স্থপতি বলা হয় রাজা উইলিয়াম আলেকজান্ডারকে। ওই ওলন্দাজরা দূর্গটি দখলে রাখতে পেরেছিলো অনেক দিন, ১৫৬ বছর। ১৭৯৬ সালে তাদের হঁটিয়ে দখলে গিয়েছিলো ইংরেজরা, যাদের বলা হয় ব্রিটিশ।
অনেক বছর আগে ইউরোপ ছিলো খুব ঠান্ডার দেশ। ফসল ফলতো না। তাদের জীবীকা ছিলো মাছ ধরা। আর খাদ্য ছিলো মাছ। সেখানে গ্রীসের লোকেরা সভ্যতা তৈরি করলো। ধীরে ধীরে তারা বিলাসী হওয়ার শুরু করলো। গ্রীসের জলপাই বানিজ্য আশপাশে কদর পেতে শুরু করলো। জলপাইয়ের তেল, জলপাইয়ের খাবার জনপ্রিয় হচ্ছিলো। গ্রীক সভ্যতা সবার মুখে মুখে প্রসংশা পাচ্ছিলো। তখন ইউরোপের মানুষ ছিলো গরীব। প্রধান পেশা ছিলো মাছ ধরা, ইউরোপ মানেই জেলেদের স্থান। সেসময় ভারতবর্ষ ধনরত্নের ভান্ডার হিসেবে পরিচিতি পায়। ভারতে অল্প পরিশ্রমে অনেক ফসল ফলতো। আবহাওয়া না শীত, না গরম। বসবাসের জন্য সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। মনে করা হতো পৃথিবীর সব হিরে জহরত সব ছিলো ইন্ডিয়াতে। ওদিকে ইউরোপজুড়ে তখন বানিজ্যের বাতাস বইছিলো। বাঁচতে হলো ছড়িয়ে পড়ো যে সেখানে পারো। অনেকটা জলদস্যুর মতো তারা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। রাজা বাদশারা নাবিকদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলো। ভাস্কোদা গামা, কলম্বাসসহ অসংখ্য নাবিক নেতা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলো। কলম্বাস ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলো। বিশাল মহাসাগরের কুল কিনারা ঠাহর করার মতো আধুনিক প্রযুক্তি তখনো আবিষ্কার হয়নি। কোথায় কোন দেশ অনেকে জানতো না। ফরাসী, পর্তুগিজ, গ্রীক, ওলন্দাজ এরা বানিজ্যযুদ্ধে একের পর এক সাফল্য পেতে থাকে। তাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলো ইতালী, স্পেনের নাবিকরাও। ধীরে ধীরে ওই সংস্কৃতি পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
ওদিকে শিক্ষা দিক্ষা, জ্ঞান চর্চায় জোর দিতে থাকে ব্রিটিশরা। বিশেষ করে জ্ঞান বিজ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক নৌযান এবং অস্ত্র বানানোয় তারা পারদর্শী হয়ে উঠে। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলো ফরাসীরা।
ব্রিটিশরা একে একে পুর্তগিজ, ওলন্দাজদের দখল করা আস্তানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছিলো। সেসব করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছিলো অনেক যুদ্ধে। শেষমেষ ফরাসী আর ব্রিটিশিরা দখল বানিজ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলো। একটু ভেবে দেখুন আমেরিকাও ছিলো ব্রিটিশদের দখলে। বলা চলে রাশিয়া বাদে পৃথিবীর প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতো ব্রিটিশরা। বলা হতো ব্রিটিশ সূর্য কখনো ডুবে না। ফরাসীরা ছিলো ব্রিটিশদের পরপরই। ভারতবর্ষসহ অনেক জায়গায় ফরাসীরদের তাড়িয়ে ব্রিটিশরা দখল করেছিলো। এখনো ওই দুই দেশের মধ্যে অনেক অমিমাংসিত ভূখন্ড রয়েছে।
ধান ভানতে শীবরে গীত গাইলাম। এটা বোঝানো জন্য যে, গল নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য- এসব জায়গা থেকে বানিজ্য করতে নাবিকরা পশ্চিম থেকে পূব দিকে যেতো। যাওয়ার পথে ভারত বা বঙ্গোপসাগর এড়িয়ে চলতো দুটো কারণে। যাতে সোজা পথে গেলে জ্বালানী খরচ কম লাগে। আরেকটা ভয় ছিলো জলদস্যুদের। টানা ২/৩ মাস নৌকায় থেকে তারা হাঁপিয়ে উঠতো। তাদের যাত্রা পথে গল পড়তো। কারণ শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে দক্ষিণের ভূখন্ড এটা। ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে দক্ষিণের ডাঙ্গা। আর ওই ডাঙ্গায় নেমে হাঁটাহাটি করা, রানন্না বান্না করে খাওয়া কিম্বা জৈবিক চাহিদার তাগিদে নাবিকরা গলে নামতো। একটা সময় এর ভৌগলিক বা বানিজ্যিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। মুখ মুখে রচিত পৌরানিক কাহিনী বা ধর্মগ্রন্থেও এর গুরুত্ব বাড়ে। সবমিলিয়ে গল ছিলো আকর্ষণীয় জায়গা। আর তাই গলের প্রতি সবার দুর্বলতা ছিলো।
(চলবে..)
আপনার মতামত লিখুন