জেগে উঠছে পর্যটন
একটুখানি সবুজ খুঁজি, একটু সবুজ হাওয়া/এই শহরে একটু সবুজ, অনেক বেশি পাওয়া/একটুখানি সবুজ খুঁজি, হলুদ চোখের কোণে/খুঁজে বেড়াই একটু সবুজ, অবুঝ কারো মনে/খুঁজে বেড়াই সবুজ পাড়া, খুঁজি সবুজ বন/কে আমাকে ফিরিয়ে দেবে, সেই সে সবুজ মন- সবুজ প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার এই আকুতি মানুষের আদিকাল থেকেই। ঘুরে বেড়াতে সবাই ভালোবাসে। আর এই ঘুরে বেড়ানোকে কেন্দ্র করে সময়ের পালাবদলে এর মাঝে মানুষ খুঁজে নিয়েছে জীবিকা। সৃষ্টি হয়েছে এক শিল্প পর্যটন। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যটন শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
পৃথিবীজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাবে দেশের পর্যটনের টালমাটাল অবস্থা। পর্যটকের যাতায়াত কমায় প্রকৃতি ধীরে ধীরে পুরোনো রূপ ফিরে পেলেও পর্যটনে ছিল দুঃসময়। তবে সে দুঃসময়কেও পেছনে ফেলে সামনে এগোনোর প্রেরণা হয়ে কাজ করে যাচ্ছে পর্যটন-সংশ্নিষ্ট অনেক মানুষ।
দেশে দীর্ঘদিন পর শর্তসাপেক্ষে খুলছে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র। দুই ঈদেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ ছিল। ভ্রমণপিপাসুদের যাতায়াত ছিল নিষিদ্ধ। ক্ষতি পোষাতে আর পর্যটক আকৃষ্ট করতে নতুন করে সেজেছে বিভিন্ন পর্যটন স্পট। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে ফিরছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে নতুন করে লোকবল বাড়ানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ভ্রমণে বের হতে না পারার অস্বস্তি কাটাতে পর্যটন কেন্দ্রে আসার জন্য মানুষ মুখিয়ে আছেন। তারপরও সরকারের স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা মেনেই পর্যটকদের সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন তারা।
পর্যটন কেন্দ্র দীর্ঘদিন পর খোলা প্রসঙ্গে ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ট্রিয়াব) সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বেই বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে রিসোর্ট হচ্ছে পর্যটকদের সুস্বাস্থ্যের জন্য এক অনন্য স্থান। রিসোর্টগুলো বিশেষ করে গ্রামীণ রিসোর্ট স্বাস্থ্যনিবাস হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১৯ সালে প্রণীত বিধিমালায় রিসোর্টের ডেফিনেশন হচ্ছে, রিসোর্টগুলো সমুদ্র বা নদী, হ্রদ বা বিল, ঝিল বা দিঘি, হাওর বা বাঁওড়, ডোবা-নালা বা খাল, পাহাড়, বন-জঙ্গল বা বাগানসহ উন্মুক্ত স্থানে হতে হবে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় রিসোর্টগুলো শহর থেকে দূরে গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর পরিমাণ ফরমালিনমুক্ত শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস ঔষধি গুণাগুণসমৃদ্ধ খাবার, প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য পাওয়া যায়, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ ছাড়া এখানে আয়ুর্বেদিক সবকিছু উৎপাদন হয়, যা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে অতিথিদের পরিবেশন করা হয়ে থাকে। সাধারণত কটেজগুলো একটি থেকে অন্যটির দূরত্ব অনেক বিস্তৃত। সুতরাং একজন গেস্ট থেকে অন্যজনের করোনা সংক্রমণের কোনো উপায় নেই। তবুও এ ক্ষেত্রে কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অতিথিদের সেবা দেওয়া হতো এবং ১৯ তারিখের পর আরও কঠোরভাবেই দেওয়া হবে।
ভ্রমণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিইএ) চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সাগরের মতামত হচ্ছে, দীর্ঘ বিরতির পর এই মুহূর্তে কম মূল্যে ভালো সেবা দিয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যটনে দেশের মানুষকে আকৃষ্ট করতে চাই। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করব। বিটিইএর ৮৫০টি সদস্য প্রতিষ্ঠান। পর্যটকদের এ বিষয়ে আমরা সচেতন করব। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা না গেলে পর্যটন কেন্দ্র খোলার সুফল তুলতে পারব না। আমরা বরাবরই বলি, বাংলাদেশে ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে মাত্র ২০ শতাংশ পর্যটক ভ্রমণ করেন। তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সচেতন করে ট্যুর অপারেটর। কিন্তু আলাদা ভ্রমণ করা পর্যটকদের সচেতন করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। পর্যটন শিল্পে জড়িত কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার দাবি জানাই।
আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসকে কেন্দ্র করে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উচিত ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা। মানুষকে ভ্রমণে উৎসাহিত করা। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগামী দুই বছর কোনো নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে পর্যটন স্পটগুলো চালু রাখতে হবে।
বিগত বেশ কয়েক বছর তরুণদের হাত ধরে পর্যটনে ভিন্নমাত্রা সংযোজিত হয়েছে। যদিও মহামারির প্রভাবে অনেক নতুন উদ্যোক্তা পর্যটন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনলাইন ট্রাভেল গ্রুপের অন্যতম উদ্যোক্তা ট্যুর গ্রুপ বিডি (টিজিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরানুল আলম বলেন, বিগত কয়েক বছরে অপার সম্ভাবনাময় একটি সেক্টর হয়ে এগোচ্ছিল পর্যটন। গত পাঁচ বছরে দেশে এবং বিদেশে পর্যটকের সংখ্যাও বেড়ে অনেক গুণ, যার সুফল বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে অনেকটা। যদিও অনাকাঙ্ক্ষিত প্যান্ডামিক সিচুয়েশনে এই সেক্টরের বেশ অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে, তবে পর্যটন আবারও আগের রূপ ফিরে পেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।
এর সঙ্গে তিনি আরও যোগ করে বলেন, বিগত ছয় থেকে সাত মাস ঘরে থেকে আমরা প্রায় সবাই আমাদের জীবনে ভ্রমণের গুরুত্ব কিছুটা হলেও টের পেয়েছি। শরীর এবং মন চাঙ্গা রাখতে হলে ভ্রমণের বিকল্প খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। ভ্রমণের মাধ্যমে একদিকে আমরা যেমন নতুন অনেক জায়গা এবং অনেক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি, অন্যদিকে মনও খুব স্নিগ্ধ একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যায়। ফলে নিজেদের জীবনেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মাদক, অবসাদ, হতাশাসহ অনেক কিছু থেকে মুক্ত রাখতে ভ্রমণ বেশ ভালো প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
রিসোর্টে সর্বদাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয় বলে দাবি করেন ট্রিয়াব সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যেহেতু রিসোর্টে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের মতো উপচে পড়া ভিড় হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকে না তাই পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ হলেও কভিড পরিস্থিতির স্বার্থেই রিসোর্ট বন্ধ করা ঠিক হবে না বলে মনে করছি। প্রয়োজনে প্রতিটি রিসোর্ট যেসব জেলায় অবস্থিত সেসব জেলার প্রকাশকরা এসব রিসোর্ট পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং সব অনিয়ম ও ৫০% এর উপরে লোক এলে রিসোর্টগুলো বন্ধ করে দিতে পারেন।
একই সঙ্গে তিনি পর্যটন ব্যবসায়ীদের রক্ষায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, 'সরকার ঘোষিত ঋণের সুবিধা আমরা এখনও পাইনি। যে কারণে এ খাতের লোকসান কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে আমি মনে করি পর্যটন সংশ্নিষ্ট সব ব্যবসায়ের ওপর ভ্যাট সাময়িক সময়ের জন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত।'
বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। রয়েছে সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। সবুজ পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় বান্দরবনের অপরূপ সব পাহাড় ঘুরে। আমাদের পুরো পার্বত্য অঞ্চলই অঘোষিত পর্যটন কেন্দ্র। এ ছাড়া আছে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, কৃষি, মৎস্য শিকার, ধর্মীয় রীতিনীতি, আদিবাসী সংস্কৃতি ও গ্রামীণ জীবন ঘিরে পর্যটনের আলাদা আলাদা সম্ভাবনা।
সিলেটের চা বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, তামাবিল, মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাত, পাহাড়, ঝরনা সব মিলিয়ে নানা বৈচিত্র্যের সম্ভার রয়েছে সীমান্তঘেঁষা বিস্তীর্ণ সবুজ লীলাভূমি। ঐতিহ্যময় বাংলার সৌন্দর্য সুন্দরবন, বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, রামসাগরসহ সারাদেশের আকর্ষণীয় সব পর্যটন কেন্দ্র পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। এ দেশের গ্রাম অনিন্দ্য সুন্দর। গ্রামগুলো কেন্দ্র করে অনায়াসেই গ্রামীণ পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ থাকা দরকার। পর্যটকদের সামনেও দেশকে চেনাজানার একটি সুযোগ চলে এসেছে করোনা মহামারির কারণে। করোনাভাইরাস দেশীয় পর্যটকদের অভ্যন্তরীণ ট্যুরিজমের প্রতি আকৃষ্ট করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য দেশীয় পর্যটন শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিণত করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন