বদলে যাওয়া প্রাথমিক শিক্ষা
মো. ইসমাইল হোসেন।।
জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ। জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার ভিত্তিমূল হল প্রাথমিক শিক্ষা। তাই দেশের সকল শিশুর জন্য মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। শিক্ষার এই স্তর পরবর্তী সকল স্তরের ভিত্তি সৃষ্টি করে বলে যথাযথ মানসম্পন্ন উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি সূচিত হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতির পিতার দেখানো পথেই হেঁটেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি পাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন এবং ১,০৫,৬১৬ জন শিক্ষকের চাকুরী সরকারি করেন।
এ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে বিগত কয়েক বছরে দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় চমৎকার অগ্রগতি হয়েছে। সরকারের গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, বিদ্যালয়বিহীন এলাকার ১৫০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, PEDP-4 এর আওতায় ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ, ঢাকা শহরের বিদ্যালয়গুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে ১২০০ কোটি টাকার প্রকল্প, বেশ কিছু বিদ্যালয়ে সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ বসানো ইত্যাদি।
ভৌত অবকাঠামোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনেই রঙিন বই তুলে দেওয়া, উপবৃত্তি কার্যক্রম, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ফিডিং চালু, সরকারি বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম-প্রহরী নিয়োগ, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু, সততা স্টোর, খুদে ডাক্তার কার্যক্রম ও স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হচ্ছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়ে ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়াসহ ইন্টারনেট ডিভাইস চালু করা হয়েছে। বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রায় শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি, কাব-স্কাউটিং কার্যক্রম জোরদারকরণ, শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সমতা আনা ও শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ নিঃসন্দেহে সরকারের অগ্রসর চিন্তার পরিচয় বহন করে।
শিক্ষক স্বল্পতা দূর করতে প্রায় প্রতিবছরই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এক বিশাল সংখ্যক শিক্ষক। এসব শিক্ষককে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পিটিআইসমূহে আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া, উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের মাধ্যমে নিয়মিত ক্লাস্টার ভিত্তিক ও বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়ে থাকে।
শিশুদের নিকট বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে প্রত্যেক বিদ্যালয়ে বিশেষ উদ্যোগে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। প্রায় সকল বিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো হয়ে উঠেছে এক একটি বইয়ের পাতা। দেয়ালে দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানান শিক্ষণীয় বিষয়।
এছাড়া, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের গৌরব উজ্জ্বল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জাতির পিতার গৌরব গাঁথা জানাতে বিদ্যালয়ের দেয়ালসমূহে সাজিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। প্রত্যকটি বিদ্যালয়ে রয়েছে ‘শেখ রাসেল কর্নার’, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে গরে তোলা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’।
সরকার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার যোগ্যতাসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তুলতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুমোদন দিয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) বাস্তবায়ন শেষে আগামী বছর থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে চালু হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম—দুটোই থাকছে। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভীতি দূর, শিশুরা আনন্দের সাথে শিখবে এবং তাদের সৃজনশীলতা বিকশিত করতে পারবে।
সরকারের গৃহীত নানা উদ্যোগের ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উপযোগী হয়ে উঠেছে। তবে, করোনা অতিমারির ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন-ঘাটতি তৈরি হয়েছে। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শিখন-ঘাটতি নিরূপণ ও তা পূরণে কী ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন তা সঠিক গবেষণার মাধ্যেমে নিরূপণ করা প্রয়োজন এবং সঠিক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন-ঘাটতি দূরীভূত করা সম্ভব।
প্রাথমিক শিক্ষকদের আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে। আন্তরিকতার সাথে সদিচ্ছার সম্মিলন থাকলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি দূরীকরণ সম্ভব। শিখন ঘাটতি পূরণে শিক্ষকদের বাড়তি নজর দিতে হবে, পিছিয়ে পড়া বা দুর্বল শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত / বাড়তি সময় দিতে হবে। শিক্ষকদের গতানুগতিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে শিশুদের পাঠদান করতে হবে। এতে শিশুরা পড়াশুনার প্রতি মনযোগী হয়ে উঠবে এবং দূরীভূত হবে করোনার ফলে সৃষ্ট শিখন ঘাটতি।
বদলে যাওয়া এ প্রাথমিক শিক্ষার সুফল পেতে হলে আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অংশীজনদেরও এগিয়ে আসতে হবে তাহলেই আমাদের আগামীর প্রজন্ম গড়ে উঠবে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে সারথি হতে পারবে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের এবং রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের।
লেখকঃ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী।
তারিখ: ১২ আগষ্ট ২০২২ খ্রি:
আপনার মতামত লিখুন